উপমন্যু রায়
আস্থা বলে, ‘‘আমি পেয়েছি একটা চিঠি।’’
— ‘‘চিঠি!’’ শম্পা বিস্ময়মাখা গলায় বলে।
আস্থা বলে, ‘‘হ্যাঁ।’’ আবার থামে সে। তার পর বলে, ‘‘চিঠিটার বর্তমান মালিকের নাম রিমি।’’ বলেই ফের যেন নিজেকে সংশোধন করে সে, ‘‘স্যরি, মালিক নয়, মালকিন।’’ হাসল সে।
আমরা বাকি চারজন তখন অজানা আগ্রহ নিয়ে রিমির দিকে তাকাই।
রিমি চুপ। একটু যেন হতচকিত।
আস্থা ফের বলে, ‘‘তবে আপাত দৃষ্টিতে—।’’ থেমে যায় সে। ফের বলে, ‘‘না, ভুল বললাম। প্রকৃত পক্ষে চিঠিটার মালিকানা দু’জনের হওয়া উচিত। সেই দু’জনের একজন রিমি এবং অপরজন রঞ্জন।’’
আমি হাঁ–হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা কারও বুঝতে অসুবিধে হল না।
তুমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললে, ‘‘কী—! তোরা এখনও চিঠি লিখে প্রেম করিস!’’
রিমি কোনও কথা বলে না। মাথা নীচু করে বসে থাকে।
তবে রঞ্জন তীব্র কঠোর গলায় বলে, ‘‘হ্যাঁ, তাতে হয়েছেটা কী?’’
তুমি বললে, ‘‘তোরা এত ব্যাকডেটেড!’’
রঞ্জন বলল, ‘‘ফালতু কথা বলিস না! চিঠিতে যে রোম্যান্টিকতা আছে, তোদের মোবাইল–ইন্টারনেটে তা নেই।’’
শম্পা ব্যঙ্গ করে বলে, ‘‘মনে হয় তোরা এ–সব যেন ব্যবহার করিস না!’’
এবার মুখ খোলে রিমি। বলে, ‘‘করি। তবে দরকারে। কিন্তু, আমাদের ভালবাসাটা আবেগের। সেখানে চিঠির রোম্যান্টিকতা, রোমাঞ্চের প্রয়োজন আছে।’’
শম্পা এবার আস্থাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘‘কিন্তু ওদের চিঠি তুই পেলি কোথায়?’’
আস্থার বদলে জবাব দেয় রিমি, ‘‘মনে হয় আমার খাতার ভেতরে। ওকে দিয়েছিলাম। স্যরের নোটস টুকবে বলে আমার কাছ থেকে নিয়েছিল।’’
রিমির কথা শুনে মনে হল যেন আস্থার বিশ্বাসঘাতকতায় আহত সে! আস্থা ভয়ঙ্কর অপরাধী!
আস্থা বলে, ‘‘একদম ঠিক।’’ একটু থেমে বলে, ‘‘এত রোমাঞ্চ আর আবেগের চিঠি, অথচ আমার হাতে চলে এলো, দেবীর হুঁশই ফিরল না!’’
শম্পা কিন্তু রিমিকে বিঁধল। বলল, ‘‘তোরা ডুবে ডুবে জল খেয়ে যাচ্ছিস!’’
রিমি জবাব দিল না। চুপ রঞ্জনও।
তুমি জানতে চাইলে, ‘‘কিন্তু কতদিন ধরে? জানতে পারিনি তো! তোরা কবে থেমে প্রেম করছিস?’’
রঞ্জন বলল, ‘‘অনেকদিন।’’
তুমিও বললে, ‘‘বুঝতে পারিনি তো!’’
আস্থা ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, ‘‘বুঝবি কী করে? তোর সেই ফিলিংস আছে?’’
তুমি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলে, ‘‘বাজে কথা বলিস না! তুই বুঝেছিস?’’
আস্থা গম্ভীর গলায় বলে, ‘‘পুরো বুঝিনি ঠিকই। তবে সন্দেহ হয়েছে অনেকবার।’’
শম্পা বলে, ‘‘তর্ক রাখ। এই সুখবরটা জেনে আমার ভালো লাগছে। তবে আমাদের কাছে কথাটা গোপন না–ও রাখতে পারতিস!’’
আমরা কেউই আর তর্ক বাড়াতে চাইনি। সেদিন আস্থার এই আবিষ্কারের পুরস্কার হিসেবে রঞ্জন কফি হাউসে আমাদের সকলের বিল মিটিয়েছিল।
হ্যাঁ, যাই হোক, আমাকে তোমার সেই চুমু খাওয়ার মাস কয়েক বাদে তোমার মধ্যে একটা পরিবর্তন কারও দৃষ্টি এড়াল না। তুমি কেন যেন কথায় কথায় খুব রেগে যেতে। যখন–তখন যাকে–তাকে দু–চার কথা শুনিয়ে দিতে। ব্যাপারটা আমাদের বিস্মিত করলেও আমরা কেউই তোমার ওপর অভিমান করিনি। সেই সময় একদিন একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটালে তুমি। ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে আমাকে বললে, ‘‘কাল আমি আসছি না।’’
জানতে চাইলাম, ‘‘কেন?’’
— ‘‘একটা কাজ আছে।’’ একটু থেমে বললে, ‘‘কাল দুপুরে তুই আমার বাড়ি আসবি? একসঙ্গে পড়ব।’’
— ‘‘তুই তো বললি কাল তোর কাজ আছে।’’ আমি একটু অবাক হলাম।
— ‘‘দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’’ চটজলদি জবাব তোমার।
আমি একটু চিন্তিত হয়ে ধীরে ধীরে বললাম, ‘‘তা হলে তো ইউনিভার্সিটি কামাই করতে হবে।’’
— ‘‘করবি।’’ একটু যেন তাচ্ছিল্যের গলায় তুমি জোর দিয়ে বললে।
আমি তখন বললাম, ‘‘দাঁড়া, তা হলে ওদের খবরটা দিয়ে আসি।’’
তুমি রেগে গেলে। বললে, ‘‘কেন?’’
বললাম, ‘‘না বললে ওরা যাবে কী করে?’’
দাঁতে দাঁত চেপে তুমি বললে, ‘‘আমার বাড়িতে তোর একা আসতে অসুবিধে আছে?’’
আমি বোকার মতো বললাম, ‘‘না, তা নেই। কিন্তু ওরা পড়বে না?’’
আমার দিকে তাকিয়ে তুমি হেসে ফেললে। তার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললে, ‘‘ওদের ক্লাস করতে দে। সবাই কামাই করলে নোটসের জন্য আবার অন্যদের কাছে হাত পাততে হবে।’’
আমি নির্বোধের মতো তোমার কথা মেনে নিয়েছিলাম। একবারও ভেবে দেখিনি ওদের চারজনের একসঙ্গে ক্লাস না করলেও চলত। ওদের মধ্য থেকে তিনজন বা অন্তত দু’জন তো অনায়াসে আমাদের সঙ্গে যেতে পারত!
পরদিন দুপুরে আমি যাই তোমাদের ঢাকুরিয়ার বাড়িতে। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। গিয়ে দেখি বাড়িতে তোমার মা নেই। তিনি গিয়েছেন তোমার মামার বাড়ি। আর তোমার বাবা অফিসে। একমাত্র কাজের ছেলেটিও বাড়ি নেই। তাকে তুমি ছুটি দিয়ে দিয়েছ। অর্থাৎ, বাড়িতে তুমি একা!
আমার অবশ্য মন্দ লাগেনি ব্যাপারটা। কোনও বন্ধুর বাড়ি গেলে তার বাড়ির লোকজনের সামনে আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয়। নিজেকে বোকা বোকা লাগে। ঠিকমতো সহজ হতে পারি না। অনেকে বলে, আমার স্মার্টনেসের অভাবের জন্যেই নাকি এটা হয়। সে যাই হোক, বাড়িতে তুমি একা থাকায় সেই অস্বস্তিটা আমার ছিল না। ভালোই লাগছিল।
তোমাদের বাড়ির ভেতরটা বেশ আধুনিক। আমাকে তুমি নিয়ে গিয়েছিলে তোমার শোবার ঘরে। বলেছিলে, সেটা তোমার পড়ার ঘরও। তোমার বইপত্র খাটে ছড়ানো ছিল। আমি ঘরে ঢুকে আমার বইখাতা নিয়ে চেয়ারে বসি। তুমি গেলে কফি আনতে।
আমি একা বইয়ের পাতা ওল্টাতে থাকি। সেই ফাঁকে তুমি কফি নিয়ে এলে। আমরা দু’জনেই কফি পান করতে থাকি। বাইরে বৃষ্টিটা ক্রমশ বাড়ছিল।
আমার দৃষ্টি বইয়ের দিকে থাকলেও তোমার ছিল না। শেষে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘কী হল? এবার শুরু করি চল।’’
তুমি রহস্যজনক ভাবে হাসলে। তার পর বললে, ‘‘তোর দেখি আর দেরি সইছে না! এত তাড়া কীসের?’’
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
তুমি হেসে বললে, ‘‘দাঁড়া, আগে কফির স্বাদটা ভালো করে উপভোগ করে নিই!’’
তোমার জবাবটা আমার মন্দ লাগেনি। আমিও চুপ করে কফির আমেজে মজে যাওয়ার চেষ্টা করি।
কফি শেষ হলে কাপটা টেবিলে রেখে তুমি উঠে এলে আমার সামনে।
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তোমার দিকে তাকাই। তোমার মুখে হাসির রেখা। তুমি কি কিছু বলতে চাইছ? আমি ঠিক বুঝতে পারি না। শেষে আমিই বলি, ‘‘চল, আর দেরি করা ঠিক নয়। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। এবার শুরু করি।’’
তুমি খলখলিয়ে হেসে উঠলে। বলল, ‘‘ঠিক বলেছিস।’’ আমার গলায় হাত রেখে বললে, ‘‘আর দেরি করা একেবারেই ঠিক হবে না।’’
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বোকা দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তোমার মুখের হাসি রহস্যময় হয়ে উঠল। বললে, ‘‘এবার তো শুরু করতেই হবে।’’ বলেই আমার মাথায় তোমার হাতটা রাখলে। চুলে বিলি কাটতে লাগলে। ধীরে ধীরে তোমার সেই হাত নেমে এলো আমার কানে। তার পর আমার গলায়, কাঁধে আলতো করে বোলাতে শুরু করলে।
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে শুরু করল।
আমার অবস্থা দেখে তুমি হেসে ফেললে। বললে, ‘‘কী–রে, অমন বোকা বোকা চোখে কী দেখছিস!’’
আমি কোনও জবাব দিতে পারিনি তখন। তুমি আমার গলা থেকে হাতটা সরিয়ে নিলে। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের হাত দুটো উঁচু করে মাথার পিছনে রেখে আমার দিকে হাসিমুখে তাকালে।
আমিও তাকাই তোমার দিকে।